আমরা সাধারণত আমাদের শিশুদের মসজিদে নিয়ে যাই। বিশেষ করে জুমআ ও ঈদের নামাযগুলোতে বাবা, দাদা-নানা ও ভাইয়ের সঙ্গে মসজিদে যেতে সোৎসাহে আবদার করে। তাই পাঞ্জাবি-টুপি পরে তারাও বড়দের হাত ধরে মসজিদে নামাযের জন্য চলে আসে। মসজিদ ও ইদ্গাহের টুপি-পাঞ্জাবীর শুভ্র সুন্দর পবিত্র পরিবেশে শিশুরা আনন্দ বোধ করে। এটি মুসলমানদের চিরায়ত ঐতিহ্যের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।কিন্তু সমাজের অধিকাংশ বয়োবৃদ্ধ মুসল্লিদের মাঝে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, ছোট ছোট শিশুকে মসজিদে নেয়া যাবে না কিংবা গেলেও তাদের সবার পেছনে অথবা একেবারে এক পাশেই দাঁড়াতে দিতে হবে। তাতে যতটা না সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যাটা হল- এমনভাবে এটা বলা হয় এবং এমন ব্যবহার এই কোমলমতি শিশুদের এবং তাদের অভিভাবকের সঙ্গে করা হয়, যার কারণে অভিভাবকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান।
অথচ আমরা জানি, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন, তখন তাঁর নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিজদায় বিশেষ সময় ক্ষেপণ করতেন। সাহাবিরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন।
এছাড়া মসজিদে নববি ছিল তখনকার মুসলমানদের পাঠশালা-স্কুল-মাদরাসা। এখানে নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী ও শিশু সবাই শিক্ষাগ্রহণ করতেন। মসজিদ ছিল সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার স্থান। সেখানে শিশুদের চলাফেরাও ছিল স্বাভাবিকভাবে। তাহলে আমরা কেন আমাদের শিশুদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করব?
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই শিশুদের আল্লাহর ঘরের সঙ্গে পরিচয় করানো ও নামাযে অভ্যস্ত করানো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা শিশুকালে যে জিনিসে অভ্যাস হয়, পরে তা করা সহজ হয়, নচেৎ তা ক
ঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের শিশুদের সাত বছর বয়স থেকেই নামাযের নির্দেশ দাও। আর যখন ১০ বছর বয়সে উপনীত হবে, তখন তাদের নামাযে অবহেলায় শাস্তি প্রদান করো।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং:৪৯৫)
তবে শিশুদের মসজিদে নেওয়ার ক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে, সেগুলো রক্ষার মাধ্যমে এ বিষয়ে অনিয়ম থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। নিম্নে তা বিবৃত করা হলো।
১। শিশু একেবারে অবুঝ হলে মসজিদে আনা নিষেধ
একেবারে ছোট ও অবুঝ শিশু, যারা মসজিদের মর্যাদা ও নামাযের গুরুত্ব সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না, সাধারণত অনূর্ধ্ব পাঁচ/ছয় বছর বয়সের শিশুরা এমন হয়ে থাকে – তাদের মসজিদে আনার অনুমতি নেই। কেননা এতে সাধারণত মুসল্লিদের নামাযে বিঘ্ন ঘটে। এ জন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, হযরত ওয়াসিলা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রূপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চস্বর, দণ্ডদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং:৭৫০)
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুরা না বুঝে মসজিদের আদববহির্ভূত কিছু কা
জ করে ফেলে। উচ্চস্বরে কথাবার্তা ও হৈ-হুল্লোড় করে থাকে, যা মসজিদের আদবপরিপন্থী কাজ। একটি হাদিসে মসজিদে উচ্চ আওয়াজ ও চেঁচামেচিকে কিয়ামতের নিদর্শন হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি কিছু বাচ্চা মসজিদে এসে প্রস্রাব-পায়খানাও করে দিতে দেখা যায়। এতে শিশুদের গুনাহ না হলেও বড়রা শিশুদের এ ব্যপারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গুনাহগার হবে। এক্ষেত্রে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষায় পেম্পার্স পরিয়ে আনা যেতে পারে।
এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, যদিও বুঝদার শিশুদের মসজিদে আনা একটি প্রশংসনীয় কাজ; কিন্তু একেবারেই অবুঝ শিশুদের আনা নিষিদ্ধ।
২। নামাযের কাতারে বুঝমান নাবালেগ শিশুর অবস্থান
বুঝ হয়েছে, এমন নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে বিধান হলো, যদি শিশু একজন হয়, তাহলে তাকে বড়দের কাতারেই সমানভাবে দাঁড় করাবে। এ ক্ষেত্রে বড়দের নামাযের কোনো অসুবিধা হবে না। একাধিক শিশু হলে সাবালকদের পেছনে পৃথক কাতারে দাঁড় করানো সুন্নাত। তবে হারিয়ে যাওয়া বা দুষ্টুমি করার আশঙ্কা হলে, বড়দের কাতারেও মুসল্লিদের মাঝে মাঝে দাঁড়াতে পারবে। (আলবাহরুর রায়েক : ১/৬১৮, আদ্দুররুল মুখতার : ১/৫৭১)
৩। শিশুরা বড়দের কাতারে দাঁড়ালেও নামায শুদ্ধ হবে
অনেকেরই এ ধারণা রয়েছে যে নাবালেগ শিশুদের বড়দের কাতারের মধ্যে দাঁড় করালে নামায ত্রুটিযুক্ত হয়, আসলে ব্যাপারটি সে ধরনের নয়। বরং যদিও জামাতের কাতারের সাধারণ
নিয়ম ও সুন্নাত হলো, প্রাপ্তবয়স্করা সামনে দাঁড়াবে ও অপ্রাপ্তবয়স্করা পেছনে থাকবে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে নামায অশুদ্ধ হওয়ার বা ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ জন্য শিশু একা হলে বা পেছনে দুষ্টুমির আশঙ্কা হলে বড়দের কাতারে সমানভাবে দাঁড় করানোই উত্তম।
রাব্বে কারীম আমাদেরকে আমাদের সন্তানদের মাঝে শিশুকাল থেকেই সঠিক দ্বীনি চেতনা সৃষ্টি করে দেশ ও জাতির যোগ্য উত্তরসুরি করে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।