আজ

  • মঙ্গলবার
  • ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

একটি ড্রামের ক্রয়মূল্য ১০ হাজার টাকা,কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে

আপডেট : জুলাই, ২১, ২০২০, ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

অফিস ডেস্ক>>>>

একটি ড্রাম ১০ হাজার টাকা
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প: একটি বঁটি ১০ হাজার টাকা, চামচ ১ হাজার, চেয়ার ৫০ হাজার, ১ কেজি মসলার পাত্র ২ হাজার টাকা * ব্যবস্থা নিতে কৃষিমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি -পরিকল্পনামন্ত্রী * তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

কোনোভাবেই থামছে না সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে পণ্য ক্রয়ে অস্বাভাবিক দামের প্রস্তাব দেয়া। এ যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এবার ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে ১০ হাজার টাকা করে ধরা হয়েছে একেকটি প্লাস্টিক ড্রাম ও বঁটির দাম। শুধু তাই নয়, একটি অ্যালুমিনিয়ামের বড় চামচ এক হাজার টাকা ও এক কেজি মসলা রাখার প্লাস্টিকের পাত্রের দাম দুই হাজার টাকা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এরকম আরও অনেক পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেই রয়েছে বাজারের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ দাম। গত ১৪ জুলাই ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

এর আগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকল্পে বাজারের তুলনায় বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক দাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। অনেকগুলোর ক্ষেত্রে ক্রয় করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বালিশ-কাণ্ড, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা ক্রয় এবং বিভিন্ন প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন ৪ লাখ টাকা, একটি মাস্কের দাম ৮৫ হাজার টাকা ও একটি স্যালাইন স্ট্যান্ডের দাম ৬০ হাজার টাকার প্রস্তাব। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণেই বারবার এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রস্তাব দেয়া থামছে না। দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতেই ইচ্ছাকৃতভাবে এমন প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও। গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সোমবার বলেন, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমার পক্ষে একটি একটি করে পৃষ্ঠা উল্টে দেখা সম্ভব হয় না। তবে আমি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখি। তারা সবকিছু ঠিক করে আমাকে দেন। আমি প্রকল্পগুলো একনেকে নিয়ে যাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেখানে যদি এরকম অস্বাভাবিক দাম ধরা থাকে এটা খুবই দুঃখজনক।

আমি ব্যবস্থা নিতে ফোনে কৃষিমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি। সেই সঙ্গে আজ (সোমবার) কেবিনেট মিটিং শেষেও তাকে অনুরোধ জানিয়েছি। তাছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সদস্যের কাছেও এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তিনি বলেছেন, দাম যাই ধরা থাকুক, দরপত্রের মাধ্যমে জিনিসপত্র কেনা হবে। তাহলে বেশি দামে তো কেনা যাবে না। কিন্তু আমি এটা মনে করি না। কারণ, বেশি দাম ধরা থাকলে ঠিকাদাররা সুযোগ পেয়ে যায়। তাই আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি অবশ্যই দুর্নীতির পথ তৈরি করতে করা হয়েছে। সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালীরা তাদের অর্থ বৃদ্ধি করতেই এসব পথ বেছে নিচ্ছে। বালিশ ও পর্দাসহ কেনাকাটায় নানা কেলেঙ্কারির ঘটনার পরও তারা কীভাবে এটা করার সাহস পায়? দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এমন শাস্তি না হওয়ার কারণেই বারবার একই ধরনের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি দেশের ৬৪ জেলার সবকটি উপজেলায় বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)। এটি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে কৃষিকে ব্যবসায়িকভাবে অধিকতর লাভজনক ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। চলতি মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে ফসলের ১০-১৫ শতাংশ অপচয় রোধ, চাষাবাদে ৫০ শতাংশ সময় এবং ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করা যাবে। পাশাপাশি সমন্বিত সবজাতীয় ফসল আবাদ করে কৃষি যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা যাবে। এ ছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে পোস্ট হারভেস্ট ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব হবে বলে এত টাকা ব্যয়ে হাতে নেয়া হয়েছে প্রকল্পটি।

ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ প্রকল্পে বঁটি, খাবার প্লেট, প্লাস্টিকের বাটি, চামচ ও চালের ড্রাম, চেয়ার, টেবিল, সোফা, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট টেলিভিশন, এসি ও ফ্রিজসহ বিভিন্ন পণ্যে অতিরিক্ত দাম ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি প্রস্তাব পাওয়ার পর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় এসব খুঁটিনাটি বিষয় দেখার কথা পরিকল্পনা কমিশনের। কিন্তু প্রক্রিয়াকরণ শেষে এটি অনুমোদনও পেয়েছে একনেক বৈঠকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্প প্রস্তাবে ২০০ লিটারের পানির প্লাস্টিকের ড্রামের (চাউলসহ) দাম ধরা হয়েছে একেকটি ১০ হাজার টাকা। এরকম ৩৬টির জন্য বরাদ্দ তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে এরকম একটি ড্রামের দাম ৫-৭শ’ টাকা। রান্নার জন্য সবজি কাটতে বড় একেকটি বঁটির দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বাজারে এরকম বঁটি ৩-৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব। ৩৬টি বঁটি কেনায় তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পে এক কেজি ধারণক্ষমতার প্রতিটি মসলাপাত্রের দাম ২ হাজার টাকা।

৯০টি মসলাপাত্র কিনতে মোট ব্যয় হবে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাজারে ভালো মানের মসলাপাত্র সর্বোচ্চ ৪শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৯০টি অ্যালুমিনিয়ামের চামচ কেনা হবে ৯০ হাজার টাকায়। প্রতিটির দাম এক হাজার টাকা। অথচ এগুলোর বাজারমূল্য ৩শ’ টাকার মতো। এ ছাড়া মাঝারি আকারের ৯০টি চামচ কেনা হবে ৪৫ হাজার টাকায়। প্রতিটি চামচ ৫শ’ টাকা। বাজারে ১-২শ’ টাকার বেশি নয়। ট্রেনিং সেন্টারের জন্য ৭২০টি প্লেট কেনায় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। প্রটির দাম পড়বে এক হাজার টাকা। আর হাফপ্লেটের দাম ধরা হয়েছে ৫শ’ টাকা করে। বাজারে ভালো মানের সিরামিক প্লেট ২শ’ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। প্রকল্পে একেকটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ৭২টির জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা দামে চেয়ার পাওয়া যায় স্থানীয় বাজারেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, এটা অবশ্যই অন্যায় কাজ। দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। বিষয়টি নজরে আসায় আজ (সোমবার) কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুর রউফকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি বঁটির দাম ৩-৫ হাজার টাকার বেশি হতে পারে না। ড্রামের দাম এত বেশি হবে কীভাবে? সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পটি সংশোধন করে অতিরিক্ত দাম সংশোধন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এত খুঁটিনাটি দেখা সম্ভব হয় না। যারা প্রকল্প তৈরি করেন, তারাই এসব দেখে থাকেন।

সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির দেড় থেকে দুই টন ক্ষমতার ১০টি এসির দাম ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি এসির দাম পড়বে ২ লাখ টাকা। বাজারে দেড় টন এসি সর্বোচ্চ ৯৯ হাজার টাকা আর ২ টন এসি ১ লাখ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ইন্টেল কোর আই-৫ প্রসেসর সমৃদ্ধ ১৪ ইঞ্চি মনিটরের পাঁচটি ল্যাপটপ কিনতে প্রতিটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বাজারে এমন কনফিগারেশনের ল্যাপটপের দাম সাড়ে ৫১ হাজার থেকে ৮৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতিটি সাদাকালো প্রিন্টারের দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। অথচ বাজারমূল্য আট হাজার টাকার বেশি নয়। এ ছাড়া দাবা বড় প্লাস্টিকের প্রতি সেটের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার টাকা। এভাবে ৩৬ সেটের জন্য এক লাখ আট হাজার টাকা। ফুটবল (বড়) একেকটির দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। এভাবে ৩৬টির জন্য বরাদ্দ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। ভলিবল সেটসহ প্লাটিকের ৫ হাজার টাকা করে ৩৬ সেটের জন্য এক লাখ ৮০ হাজার টাকা; উডেন কেরাম বোর্ড চার ফুট বাই চার ফুট প্রতিটি ২০ হাজার টাকা করে ৩৬টির জন্য সাত লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, এগুলো দেখার প্রথম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের। যারা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করে। তার পর আসে মন্ত্রণালয়ে। সেখানে পরিকল্পনা উইং এগুলো যাচাই-বাছাই করে। ওই মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে প্রকল্প প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব একটি সার্টিফিকেট দেয় যে, এটি প্রক্রিয়াকরণ করা যায়। তখন আসে পরিকল্পনা কমিশনে। এখানে মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টার মিটিংয়ে এত কিছু দেখা সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা চেষ্টা করি সর্বোচ্চ খতিয়ে দেখার।

সরকারের কেনাকাটার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ)। এটি পরিচালিত হয় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের আওতায়। এই বিভাগের সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ বলেন, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কেননা বেশি দাম ধরলে ঠিকাদাররা অনিয়ম করার সুযোগ পেয়ে যান। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রকল্পের পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে হবে। এটিই নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটানো হলে বলা যায় প্রকল্প প্রস্তাবটি যথাযথ হয়নি।
সংগৃহীত

error: Content is protected !!