আজ

  • শুক্রবার
  • ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জামায়াত কে নিয়েই ঐক্য হচ্ছে

আপডেট : সেপ্টেম্বর, ১৯, ২০১৮, ৩:৪০ অপরাহ্ণ

সালাহ্উদ্দিন মজুমদার>>>>

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য বাস্তবে রূপ নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ঐক্য বিষয়ের আলোচনায় ইতিবাচক বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।আগামী মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) নাগাদ ঐক্যের নতুন খবর দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলরা।সম্ভাব্য এই ঐক্যের বাধা হিসেবে এতদিন জামায়াতে ইসলামীকে দেখা হলেও শেষ পর্যন্ত ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রেখেই নতুন বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্তত পাঁচজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।এই নেতারা জানিয়েছেন, ২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য থাকলেও বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যে জামায়াত থাকছে নাএ নিয়ে বিএনপির নেতারা ঐক্যে আগ্রহী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল বিকল্প ধারা। দলটি চাইছে, জামায়াতকে ছেড়ে দিয়ে বৃহত্তর ঐক্যে আসুক বিএনপি।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা চলছে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যে আগ্রহী দলগুলো হচ্ছে— ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, আসম রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। এই প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে থাকলেও কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। ২০১৬ সালে কাদের সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে তিনি জান্নাতেও যেতে চান না।’আগামী মঙ্গলবার ড. কামাল হোসেনের বাসায় একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ বৈঠক থেকেই নতুন খবর আসবে, এমন তথ্য জানিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী  বলেন, ‘ভালো খবর আসবে, অপেক্ষা করুন।জামায়াতের বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াত বৃহত্তর ঐক্যে থাকছে না। তাদের সঙ্গে বিএনপির যে জোট আছে, সেটা থাকবে। তারা গোপন থাকবে। তারা প্রকাশ্যে আসবে না।’

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না  বলেন, ‘জামায়াত তো বিএনপির সঙ্গে; বিএনপি কী করবে, সেটা তারাই ঠিক করুক। জোটের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। আরও আলোচনা হওয়ার পর সিদ্ধান্ত জানা যাবে। ’যুক্তফ্রন্টের আরেক শীর্ষনেতা বলেন, ‘জামায়াত বিএনপির সঙ্গে থাকবে। তবে বৃহত্তর জোটে আসবে না। বৃহত্তর জোটের কর্মসূচিতে কেবল বিএনপি আসবে। এটাই আমাদের কনসেপ্ট।’বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য  বলেন, ‘দুয়েকটি দ্বিমত ছাড়া জামায়াতকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমাদের সঙ্গে জামায়াত বৃহত্তর ঐক্যে আসছে না। তারা ২০ দলীয় জোটেই থাকবে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের ভাষ্য বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য জামায়াত কোনও বাধা নয়। নির্বাচনি কাজেও জামায়াতকে প্রয়োজনে সম্ভাব্য জোট নেতাদের আসনের বাইরে রাখা হবে। কোনও পক্ষকেই কোনও পক্ষের কাজে লাগানো হবে না।’

বিকল্প ধারার যুগ্ম-মহাসচিব মাহী বি.চৌধুরী জানালেন, ‘জামায়াতকে বন্ধু হিসেবে রেখে বিকল্প ধারা বিএনপির সঙ্গে কোনও ঐক্য করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিরেক্ট বা ইনডিরেক্ট, জামায়াতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখলে বিকল্প ধারা সেই ঐক্য করবে না।’বি চৌধুরীর আরেকটি প্রত্যাশার জায়গা হচ্ছে ভারসাম্যমূলক নীতি। নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সঙ্গে আসনভিত্তিক ভারসাম্য চান তিনি।২৩ আগস্ট এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, ‘একমাত্র ভারসাম্যের রাজনীতিই স্বেচ্ছাচারমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারে। নির্বাচনে কোনও দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে দেশে স্বেচ্ছাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ইতিহাস আমাদের এ শিক্ষা দেয়।’এ ভারসাম্যের পক্ষে আছেন বিএনপির নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই। বিএনপির সামনে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ঐক্য। আর অর্থবহ ঐক্য করতে হলে অবশ্যই ছাড় দিতে হবে।’

উদাহরণ টেনে স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের আশেপাশে এই উদাহরণ আছে। মালয়েশিয়ায় মাহাতির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের যুক্ততা বেশিইব্রাহিমের দল বড় হলেও মাহাতিরকেই সামনে রেখেছে। এছাড়া, সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যমে বেরিয়েছে, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ইতোমধ্যেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, আগামী নির্বাচনের আগে ওই দেশে বিজেপিবিরোধী জোট নির্বাচনে বিজয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী করা হবে কোনও রাজ্য থেকে।স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘পুরনো দিনের কলাকৌশল ও মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ছাড়ের চিন্তা করতে হবে বিএনপিকে। তাহলেই ঐক্য সফল হবে।’ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ আশাবাদী। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সব দলকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

শুক্রবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান  কাছে মন্তব্য করেন, ‘সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজস্ব পলিসি ঠিক করার পরই বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে।’যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আগামী মঙ্গলবারের বৈঠকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতকে রেখেই বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যে আসা, ঐক্যের নীতি, প্রস্তাবসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হবে।বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ‘আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলো নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে ঐক্য না করলেও ঠিকই ঐক্য করতে হবে, অন্য কোনও শক্তির প্রেশারে। সেক্ষেত্রে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু থাকবে না।’এই সূত্রের দাবি, ‘তিনটি শক্তিশালী গোষ্ঠী এই জোট গড়ার পক্ষে আছে। তারা এখনও চাপ না দিলেও আরও সময় ঘনালে এই চাপ আসতে পারে।’ এক্ষেত্রে বিএনপির সমালোচনাও করেছে এই সূত্রটি।

দায়িত্বশীল সূত্রটির পর্যবেক্ষণ— ‘রাজনৈতিক ঐক্য করার যে শক্তি, সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির নেই। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা, অর্থ কাজে লাগালেও বিএনপির সে সক্ষমতা নেই। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কৌশলই একমাত্র অবলম্বন।কিন্তু এই কৌশল এখনও চূড়ান্তভাবে কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। আগামী কয়েকদিন পরই সেপ্টেম্বরে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, এরপর জাতীয় সরকার গঠন, নির্বাচন তফসিল ঘোষণা ইত্যাদি ইস্যুর ব্যস্ততা সামনে থাকলেও পরিকল্পনা এখনও টেবিলেই।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতকে ত্যাগ করার বিষয়ে বিএনপিতে এখনও কাজ চলছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সমালোচনাকে কেন্দ্র করে একাত্তরের বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতকে বাদ দিয়েই সম্ভাব্য ঐক্য এগিয়ে নিতে চাইছে দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ।

এই অংশটি বলছে, ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর সরকার গঠনে পূর্ণ আসন পায়নি বিএনপি। ওই সময় রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের আলোচনা হলেও তখন একটি গ্রুপ জামায়াতকে যুক্ত করে। ওই সময় জামায়াত সংসদে ১৮ আসন পেয়েছিল। তাদের সমর্থন নিয়ে বিএনপিকে সরকার গঠন করতে হয়।এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের ভাষ্য, ‘তাদের প্রতি বিএনপির উইকনেস তৈরি হয় ১৯৯১ সালেই।’যদিও গত ৩০ জুলাই সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াতের আলাদা প্রার্থী দেওয়ার পর জেলা পর্যায়ের বিএনপি নেতারা ঢাকায় এসে হাইকমান্ডকে জানিয়েছেন, জামায়াতকে বাদ দিয়েই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য করতে।

যদিও দলের কয়েকজন নেতা চাইছেন, জামায়াতকে সঙ্গে রেখেই নির্বাচনে যাক বিএনপি। বিশেষ করে জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়ে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার কোনও মতই নেই। পরে গত ১৪ আগস্ট মির্জা ফখরুল এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সিদ্ধান্ত যা ছিল, তাই আছে। জোটে তো তারা আছেই, এটা তো বারবারই আমরা বলেছি।’জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার অবশ্য তেমনটি মনে করছেন না। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে জোটবদ্ধ থাকার। যে ঐক্য আছে, তা বহাল থাকবে।বিএনপির সঙ্গে ও ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যে আলোচনা বা সর্বশেষ যেসব অগ্রগতি, তাতে ২০ দলীয় জোট অটুট থাকবে। এর বাইরে যেসব দলের মধ্যে ঐক্যের যে আলোচনা চলছে, তাতে আমাদের কোনও দ্বিমত নেই।’গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, ‘এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলন হয়েছে, জোটে-জোটে লিয়াঁজো হয়েছে। ভিন্ন-ভিন্ন জোটে ঐক্য হয়েই ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমাদের সমর্থন থাকবে। আমরা নীতিগতভাবে একমত।’

শনিবার (২৫ আগস্ট) দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে নির্দেশনা আনতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় একঘণ্টা বৈঠক করে এসেছেন। দলীয় নেতাদের ধারণা—সম্ভাব্য বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের রূপরেখা, আগ্রহী দলগুলোর প্রত্যাশা বিষয়ে পর্যালোচনা, আগামী নির্বাচনের আগে দলের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুজনের মধ্যে।বিএনপির নেতাদের অনেকেই বলছেন, ১৯৯১ সালের মতো জামায়াতকে রেখে ফের কোনও সিদ্ধান্তে না যেতে। বিশেষ করে দলের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক কৌশল, কর্মপন্থা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে কারও-কারও।

error: Content is protected !!